Tags: টাঙ্গাইল
সারাদেশে নিত্যপণ্যের লাগামহীন উধর্বগতি,নিম্ন আয়ের মানুষগুলো জীবিকা নির্বাহে আজ দিশেহারা। ছোট-ছোট ব্যবসায়ীরা দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারলেও বিপাকে পড়েছে কৃষক-তাঁতী, জেলে, কুমার, কামার, খেটে খাওয়া দিন মুজুর ও মধ্যেবিত্তরা।
পরিবারের ভরণপোষন ও সন্তাদের লেখাপড়া নিয়ে চরম হতাশায় ভুগছেন তারা। প্রতিটি গ্রামে চলছে এমন হাহাকার ও শুনশান নীরবতা। না পারছে সংসার চালাতে না পারছে সন্তানদের চাহিদা মেটাতে। এ সবের কারন খুঁজতে গিয়ে প্রতিবেদকের চোখে ধরা পড়ে ভিন্ন চিত্র। দেখা মিলে বনের ভিতর কিছু বয়স্ক লোক ও মধ্যে বয়সী মহিলারা বনের ঝড়া পাতা কুড়িয়ে বস্তা বন্ধি করছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় অজানা অনেক দুঃখ কষ্টের কথা।
মনে পড়ে আব্দুল জব্বারের গান ‘তুমি কি দেখেছ কভু/ জীবনের পরাজয়…….শুকনো পাতার মর্মরে বাজে/ এ গানের মতো করেই মাঘ-চৈত্র মাসে টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়া লের গাছের পাতা ঝড়ে পড়ে। বর্তমানে ওই ঝড়াপাতা কুড়িয়ে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন বনা লের প্রায় তিন হাজার পরিবার। ফলে বনে আগুন লাগার আশঙ্কা কমছে। এতে একদিকে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে।
অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোতে অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে।
জানাগেছে, দেশের জামালপুর জেলার দক্ষিন অংশ, নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা উপজেলা, টাঙ্গাইল জেলা ও গাজীপুর জেলার বনভূমি নিয়ে মধুপুর গড় অ ল গঠিত। গড়া লের উত্তর অংশ মধুপুর গড় ও দক্ষিন অংশ ভাওয়াল গড় হিসেবে পরিচিত। টাঙ্গাইল বন বিভাগের আওতায় ৯টি রেঞ্জে ৩৪টি বিট, তিনটি সামাজিক বনায়ন নার্সারী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ৯টি সামাজিক বনায়ন কেন্দ্র রয়েছে।
মধুপুর গড়া লে টাঙ্গাইল বন বিভাগের রেঞ্জগুলো হচ্ছে- টাঙ্গাইল সদর রেঞ্জ, ধলাপাড়া রেঞ্জ, হতেয়া রেঞ্জ, বহেড়াতলী রেঞ্জ, বাঁশতৈল রেঞ্জ, অরণখোলা রেঞ্জ, মধুপুর রেঞ্জ, দোখলা রেঞ্জ ও মধুপুর জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জ। এরমধ্যে মধুপুর গড়া লের মির্জাপুর, সখীপুর, কালিহাতী, ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলায় প্রাকৃতিক ও সৃজিত উডলট বাগান রয়েছে। মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলার প্রাকৃতিক বনে সবচেয়ে বেশি শাল-গজারী ও সেগুন গাছ পাওয়া যায়।
ষড়ঋতুর এ ব-দ্বীপে বঙ্গীয় মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত এতদা লের আবহাওয়া এক প্রকার নাতিশীতোষ্ণ থাকে। শীতের পিঠা-পায়েসের পর বাঙালি হৃদয়ে বসন্ত দোলা দেয়। বনের গাছ-গাছালি পাতা ঝড়িয়ে নবরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ওই ঝড়েপড়া পাতাগুলোই প্রায় তিন হাজার পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটাচ্ছে।
সরেজমিনে মধুপুর গড়ের জয়নাগাছা, পীরগাছা, চুনিয়া, ফেকামারী, লুহুরিয়া, অরণখোলা, কামারচালা, সানিয়ামারী, ভুটিয়া, গাছাবাড়ি, ফুলমালিরচালা, বাঁশতৈল, কাকড়াজান, যোগীরকোফা, বহেরাতলী, ঝড়কা, ঘোড়ামারা, দেওপাড়া, ধলাপাড়া, চৌরাসা, বটতলী ইত্যাদি এলাকা ঘুরে দেখাগেছে, নিম্ন আয়ের মানুষরা ভোর থেকে বিকাল পর্যন্ত শাল-গজারী গাছের ঝড়াপাতা সংগ্রহ করছেন। সেগুলো ঘোড়ার গাড়ি ও ভটভটিতে খাঁচা তৈরি করে পাতা নিচ্ছেন। সংগ্রহ করা পাতাগুলো তারা আনারস চাষিদের কাছে প্রতিগাড়ি(৮-১০ মণ) ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি করছেন।
মধুপুরের চুনিয়া বন থেকে পাতা সংগ্রহকারী মফিজুল ইসলাম জানান, তার বাড়ি মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ি গ্রামে। তার প্রথম মেয়ে মিম স্থানীয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণি ও ছেলে রনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। অপর মেয়ের বয়স চার বছর। তিনি পেশায় কৃষিজীবী। মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত কোন কাজ না থাকায় তিনি বন থেকে ঝড়াপাতা সংগ্রহ করে আনারস চাষিদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতিদিন তিনি এক গাড়ি পাতা সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে পারেন।
একই উপজেলার হাতিমারা গ্রামের আমির হোসেন জানান, তিনি এক মেয়ে ও তিন ছেলের জনক। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে মিলনের বয়স ১৩ বছর। অভাবের কারণে লেখাপড়া করাতে পারেন নি। বছরের অন্য সময় তিনি দিনমজুরী করেন। মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বনের ঝড়াপাতা সংগ্রহ করে বিক্রি করেন।
সোনাতন গ্রামের বাদশা মিয়া জানান, তার মেয়ে ভাবনা এইচএসসিতে পড়ালেখা করে। অপর মেয়ের বয়স তিন বছর। তিনি পেশায় দিনমজুর। মেয়ের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ যোগাতে তিনি বন থেকে পাতা সংগ্রহ ও বিক্রি করছেন।
মধুপুরের দোখলা রেঞ্জ অফিসার মো. ইসমাইল হোসেন জানান, বনের ঝড়াপাতায় আগুন দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কাঠ চোররা বনের গাছ কেটে নিয়ে যায়। তাছাড়া সিগারেটের আগুনে যে কোন সময় আগুনের উপদ্রব হতে পারে। ঝড়াপাতা সরিয়ে নিলে আগুন দিতে পারেনা। তাই তারা স্থানীয়দের ঝড়াপাতা সংগ্রহে উৎসাহ দিয়ে থাকেন।
তিনি জানান, বনের গাছ রক্ষায় ঝড়াপাতা সরানো অতীব প্রয়োজন। তারপরও মাঝে মাঝে চোরের উপদ্রপ লক্ষ করা যায়। এজন্য সিএফডব্লিউরা দিনরাত বনে দায়িত্ব পালন করে থাকে। সম্প্রতি চোরদের ধাওয়া করে তারা বেশকিছু কাঠ জব্দ করেছেন। তবে পাতা কুড়ানোর অজুহাতে কেউ যদি গাছ কেটে নেয় সে ব্যপারে আমরা সদা সতর্ক আছি।
টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুর রহমান জানান, ঝড়েপড়া পাতা বনেরও অনেক উপকারে আসে। পাতা পঁচে জৈব সার সৃষ্টি হয়- যা বনে চারাগাছ জন্মাতে সাহায্য করে। তবে ঝড়েপড়া পাতা বিক্রি করে কিছু মানুষের উপকারও হচ্ছে- এটা বনে আগুন দেওয়াকে অনেকটাই নিরুৎসাহিত করে।